একটা উপমা দিয়ে শুরু করি। অন্তুর বয়স ৫ বছর। একদিন অন্তুর মা দেখলেন অন্তু তার বন্ধু, রনির লাল খেলনা গাড়িটা বাসায় নিয়ে এসেছে। মা জানতে চাইলেন, “বাবা তোমাকে এই গাড়ি কে দিয়েছে? অন্তু বলল, “কেউ দেয় নি। আমার ভাল লেগেছে তাই নিয়ে এসেছি।” মা জানতে চাইলেন, “রনিকে বলেছো যে তুমি গাড়ি নিয়ে এসেছো?” অন্তু বলল, “না”। মা প্রচন্ড বিরক্ত হলেন। এর আগেও অন্তু রনির খেলনা না বলে নিয়ে এসেছিল। ইদানিং সে বানিয়ে বানিয়েও অনেক কথা বলছে। মা অনেকবার অন্তুকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, “বাবা মিথ্যা কথা বলা ভাল না”। বলেছেন, “কাউকে না বলে তার জিনিস আনা খুবই খারাপ কাজ”। কিন্তু কাজ হয়নি। অন্তু এসব বার বার করেছে। আজ মা আর তার রাগ ধরে রাখতে পারলেন না। উনি খুব বকাঝকা করলেন অন্তুকে এবং শেষমেষ অন্তুকে মেরেই বসলেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে ৫ বছরের শিশু কি মিথ্যা বলে বা চুরি করে ব্যাক্তিগত স্বার্থলাভের বিষয়টা বোঝে? বোঝে না। মালিকানা বা অধিকার বোঝার মত বয়স তার হয় নি তাই যেটা ভাল লেগেছে নিজের মনে করে নিয়ে এসেছে। তাহলে এই শিশুকে বড়দের মত সত্য মিথ্যা বা ন্যায় অন্যায় এর ভাল মন্দ বুঝিয়ে কি কোন লাভ হবে? লজিক বলে, হবে না। তাহলে এই গুরুত্বপূর্ন মোরাল বিষয়গুলো তাদের মাথায় ছোট বেলাতেই দিয়ে দেয়া যায় কিভাবে?
ছোট শিশুদের মাথায় ন্যায় অন্যায় সত্য মিথ্যার বিষয়গুলো গেঁথে দেয়ার একটা অসাধারন উপায় হতে পারে তাদের নিয়মিত গল্প বলে শোনান। হ্যা, একটা গল্প, শিশুদের ক্ষেত্রে বোঝানোর চেয়ে হাজার গুন বেশি কার্যকর হয়। গল্প বলে শোনানোর আরও অনেক কার্যকারিতা আছে তবে আজ আলোকপাত করছি গল্প এবং মোরাল ডেভেলপমেন্ট এর বিষয়ে।
পৃথিবীতে হাজার হাজার গল্প আছে যেগুলো ছোট শিশুদের মোরালিটির কথা শোনায় এবং শেখায়। একটা গল্প শুনিয়েই যে কোন শিশুর মোরাল ডেভেলপমেন্ট হয়ে যাবে তাও কিন্তু নয়। তাকে নিয়মিত ভাল ভাল গল্পগুলো শোনাতে হবে। শিশু যখন গল্প বুঝতে শুরু করবে অর্থাৎ ৩/৪ বছর থেকে রোজ আপনি এই গল্পগুলো শিশুকে শোনান। মোরাল ডেভেলপমেন্ট একটা ধীর ও দীর্ঘমেয়াদি প্রসেস। গল্পের শিক্ষা গুলো শিশুর মাথায় প্র্যাকটিক্যাল শিক্ষার মত গেঁথে যাবে। ন্যায়কে সমুন্নত করা আর অন্যায়কে প্রশ্রয় না দেয়া তার অভ্যাসে পরিনত হবে। সে আপনা আপনি মোরাল ভার্চু নিয়ে বেড়ে উঠবে।
শিশুদের গল্প বলে শোনান উচিত নিয়মিত। আজ বললাম আর ৫ দিন বললাম না এমনটা কার্যকর হবে না। সবচেয়ে ভাল হয় মহাপুরুষদের গল্প শোনালে এতে ছোটবেলা থেকে তারা সেই সব মানুষদের আইডল হিসেবে গ্রহন করবে, যা পরে তাদের পাথেয় হবে। গল্পগুলোতে যে মোরাল শিক্ষাটা পাওয়া গেল তা জোর দিয়ে গল্পের শেষে তাকে বুঝিয়ে দিন। সে বুঝতে পেরেছি কিনা তা প্রশ্নের মাধ্যমে বুঝে দেখুন। এভাবে তার মনে বিষয়গুলো গেঁথে যাবে। বাজারে অনেক বই পেয়ে যাবেন যেগুলো মোরাল ম্যাসেজ দেয়। এগুলো কিনে রোজ নিয়ম করে শিশুকে শোনান।
গল্প বলতে গিয়ে শিশুদের শুধু শুধু ভয়ের গল্প বলা ঠিক নয়। এতে তাদের মনে একটা দীর্ঘমেয়াদি ভীতি তৈরি হয়। সব সময় চেষ্টা করতে হবে, যে গল্পগুলোতে পজেটিভ একটা উপলব্ধি থাকে, সে গল্পগুলো বলার। বাবা মায়েদের বা শিক্ষকদের শিশুদের জন্য গল্প সিলেকশান নিয়ে খুবই সাবধানি হতে হবে। ছোট বেলা থেকে শিশুদের যে সব গল্প শোনানো হয়, তার একটা প্রভাব তার মস্তিস্কে পড়ে। খুব ছোট শিশুরা গল্পের সাথে বাস্তবতার পার্থক্য করতে পারে না। তাই গল্পকে হাতিয়ার করে যেমন কোন বাচ্চার মোরাল ডেভেলপমেন্ট করা যেতে পারে তেমনই ভুল গল্প বলার কারনে তা নষ্টও হয়ে যেতে পারে।
সুতরাং আমরা যদি সামারি করি তাহলে পাচ্ছি, মোরাল ডেভেলপমেন্ট বাচ্চাদের বকা দিয়ে বা মার দিয়ে নয় বরং গল্প বলতে বলতে শেখানোটা বেশি কার্যকর। এবং গল্প সিলেকশান করতে হবে খুব সাবধানে। মহান ব্যাক্তিদের সত্য গল্পগুলো থাকা উচিত এক নম্বরে এছাড়াও মোরাল ডেভেলপমেন্ট নিয়ে হাজারও গল্প এবং গল্পের বই আছে বাজারে। আশাকরি আজ থেকে আপনিও আপনার শিশুকে রোজ অন্তত একটা গল্প শোনাবেন। যে গল্পগুলো শুনে আপনার শিশুও এই গল্পগুলোর মত মহান কাজ করে আপনাকে গর্বিত করবে।