দাম্পত্য জীবনের ১০ম বছরে পা দিয়েছেন রহিম রেহেনা দম্পতি। ৭ বছরের একটি ছেলে রিঙ্কু কে নিয়ে তাদের তিনজনের সংসার। সবদিক ভালো চললেও রহিম রেহেনার মাঝে প্রায় ই সংসারিক খুটিনাটি নিয়ে কথা-কাটাকাটি এবং ঝগড়া লেগে থাকে এবং সব ঝগড়ার কেন্দ্রবিন্দু থাকে ছেলে রিঙ্কু। রিঙ্কু কেন পড়ছে না, কেন খাচ্ছে না, কেন এটা করেছে, কেন ওটা করেছে এসব নিয়েই তাদের ঝগড়ার সূত্রপাত। ছোট বিষয় নিয়ে তুমুল ঝগড়ার সৃষ্টি হয় তাদের মাঝে। এসবের প্রতক্ষ্য দর্শক একমাত্র ছেলে রিঙ্কু এবং বাসার কাজের মেয়েটি। ঝগড়ার অল্প কিছু সময় বা কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে রহিম রেহেনার মাঝে সব ঠিকঠাক হয়ে গেলেও তাদের ঝগড়ার পুরো প্রভাব ছেলে রিঙ্কুর মনে স্থায়ী হয়ে থেকে যায়। সাত বছরে পা দেয়ার পর রিঙ্কু এখন মা বাবার ঝগড়া থামানোর চেষ্টা করে। বাবা মা দুজনেই রিঙ্কুকে একা পেলে একে অপরের সম্পর্কে নেতিবাচক কথাবার্তা বলে নিজেকে সন্তানের কাছে ভালো রাখার চেষ্টা করে।
একদিন বাসায় মেহমান আসার পরে সবাইকে যখন একসাথে খেতে দেয়া হলো তখন রিঙ্কু কারও সাথে খেতে বসতে চাইলো না এমনকি সে কারও সাথে ভালোভাবে কথাও বললো না। ছেলের এমন অস্বাভাবিকতা রহিম এবং রেহেনা ইদানিং লক্ষ্য করছেন। এমন আরও কিছুদিন যাওয়ার পরে রেহেনা ছেলেকে নিয়ে গেলেন একজন শিশু মনোবিশারদ ডাক্তারের কাছে কারণ রিঙ্কুর এমন হঠাৎ চুপ হয়ে যাওয়া এবং অস্বাভাবিক আচরণ দিন দিন বেড়েই চলছিলো। ডাক্তারকে সবকিছু খুলে বলেন রেহেনা। সবটা শুনে ডাক্তার প্রথম প্রশ্ন করেন, আপনার আর রহিম সাহেবের মাঝে সম্পর্ক কেমন? রেহেনা এক কথায় উত্তর দিয়েছিলেন ‘হ্যাঁ ভালো ত’ ডাক্তার আবারও প্রশ্ন করেছিলেন রিঙ্কুর সামনে আপনাদের কোনোরকম ঝগড়াঝাটি হয় কিনা? এবারও রেহেনা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ সংসারে ত টুকটাক ঝগড়া হয় ই, এটা ত আর ছেলেকে বাইরে রেখে করা যায় না’ এটি শুনে ডাক্তার হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘সমস্যা টা মূলত এখানেই’ এরপর ডাক্তার রিঙ্কুকে অনেক বুঝিয়ে, কথা বলে তার কাছে জানতে চায়, সে কেন কারও সাথে কথা বলে না, কেন কারও সাথে মিশতে চায় না? রিঙ্কু প্রথমে কিছু বলতে না চাইলেও এক পর্যায়ে কান্না করে এবং ভাঙ ভাঙা সুরে বলতে থাকে, ‘আমি কিছু বললেই মা আমাকে বকবে, কিছু করতে না পারলেই বাবা মা অনেক ঝগড়া করে, খেতে না পারলেও মা বাবা এমন করে, আমার জন্যই বাবা মায়ের ঝগড়া হয়, আমার জন্যই বাবা মা সবসময় এমন করে’ এগুলো বলেই রিঙ্কু চোখ মুছতে থাকে।
এরপর রেহেনা বুঝতে পারে রিঙ্কুর সমস্যা কোথায় এবং সে ডাক্তার কে সবকিছু খুলে বলে। ডাক্তার তাকে বলে, ‘সন্তানের সামনে কখনোই বাবা মা ঝগড়া বা কথা কাটাকাটি করা উচিত নয়। আমরা যেটাকে স্বাভাবিক মনে করি শিশুরা সেটা স্বাভাবিক মনে করতে না ও পারে সেজন্য শিশুদের সামনে কিছু বলতেও আমাদের ভেবেচিন্তে কথা বলা উচিত। খুবই ছোট বিষয় শিশুদের মনে এবং ব্রেনে প্রভাব ফেলে এবং এটা স্থায়ী রূপ ধারণ করে। বিষয় টা যদি নেতিবাচক হয় তাহলে তাদের মনে এটার নেতিবাচক প্রভাব পড়ার কারণে একটা সময় পরে যেয়ে তারা এমন অনেক অস্বাভাবিক আচরণ করে থাকে। এটার জন্য পুরোপুরি দায়ী আমাদের পরিবার, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এবং আমাদের মানসিকতা। বাবা মায়ের মাঝে রাগারাগি, ঝগড়া একটা শিশুকে মনঃক্ষুণ্ন করে। ঝগড়া টা যদি তাকে কেন্দ্র করে হয় তাহলে সে হীনমন্যতায় ভুগে, হতাশায় ভুগে এবং নিজের উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। বাবা মায়ের মাঝে সুন্দর সম্পর্ক দেখে শিশু আত্নবিশ্বাসী এবং সুস্থ মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠে যেটা তার পরবর্তী জীবনেও অনেক বড় ভূমিকা রাখে। সংসারে ঝগড়া বা কথা-কাটাকাটি স্বামী স্ত্রীর স্বাভাবিক বিষয় তবে খেয়াল রাখতে হবে বিষয় টা যেন এমন না হয় যেটাতে আপনার শিশু কষ্ট পাচ্ছে না তার মনের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এবং কোনোভাবে নিজেদের মনমালিন্যে শিশুকে দায়ী করা যাবে না। বাবা মা দুজনের মান অভিমান বা ঝগড়া হয়ত কিছু সময় পর ঠিক হয়ে যায় তবে শিশু মনে এটা দাগ কাটে স্থায়ী ভাবে সুতরাং শিশুর সামনে বা শিশুকে দায়ী করে বাবা মা ঝগড়া বা কথা-কাটাকাটি থেকে দূরে থাকতে হবে। এটি আপনার সন্তান কে সুস্থ এবং সাবলীল ভাবে বেড়ে উঠতে সহায়তা করবে’
রেহেনা বাসায় ফিরে রহিম কে সবটা খুলে বলে এবং তারা নিজেরা নিজেদের আগের করা ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়। এরপর থেকে ছোটখাটো বিষয় তারা নিজেদের মাঝে সমাধান করার চেষ্টা করে এবং একটা সময় পরে রিঙ্কুও স্বাভাবিক আচরণে ফিরে আসতে শুরু করে। তখন তারা অনুভব করে, একটি শিশুর সুস্থ, সুন্দর মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠা বাবা মায়ের মধ্যকার সম্পর্কের উপর অনেকখানি নির্ভর করে।